Breaking News
Home / Top News / নির্জন পাহাড়ি এক জনপদে

নির্জন পাহাড়ি এক জনপদে

নির্জন পাহাড়ি এক জনপদে |

সকালের শিলিগুড়িকে পিছনে ফেলে আমরা তিনজন মহানন্দা বনাঞ্চলের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছি। শাল-সেগুনের জঙ্গলে রোদের আঁকিবুঁকি। কালিঝোরা পৌঁছে বাঁ-দিকে ওপরে ওঠার রাস্তা ধরে তিস্তাকে নীচে ফেলে উঠতে লাগলাম, ঝরা পাতা উড়িয়ে আর নিঃসঙ্গ পথিককে পিছনে ফেলে। জড়িয়ে ধরছে হিমেল হাওয়া। রাস্তার পাশের পাহাড়ি বাড়িগুলোর কী সুন্দর রং! নীল, বেগুনি, কমলা। উঠোন উপচে ফুল। কতদিন বাদে দেখা হল তিস্তার সঙ্গে। এখন সে পান্নাসবুজ। বর্ষায় পাহাড়ে এসে দেখেছি, তিস্তা তখন গেরুয়াবর্ণা। একেবারে মেটামরফোসিস। একটু পরে এসে পড়লাম কমলালেবুর জন্য বিখ্যাত সিটং-এ। শীতকালে এ সবুজ পাহাড় হয়ে ওঠে আগুনরঙা। মার্চে লেবু নেই, সঙ্গী কল্পনা। গাড়ি উঠছে তো উঠছেই, চারপাশের সবুজ চূড়া কাছে আসছে, হাত বাড়াচ্ছে মেঘ। মাঝেমাঝে রাস্তাটা ডুব মারছে গাছের ছায়ায়, খাদের ভেতর থেকে উঁকি মারছে অতলান্ত সবুজ। সব নিয়ে পৌঁছে গেলাম প্রায় ৪৫০০ ফুট উচ্চতায় কার্শিয়ং-এর কাছে এক নির্জন পাহাড়ি জনপদে — অহলদারা।

গাড়ি থেকে নামতে-নামতেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। পাহাড় যেন আমাদের স্বাগত জানিয়ে বলে চলেছে… এসো, দেখো, মিশে যাও প্রকৃতিতে। যেদিকে তাকাই উন্মুক্ত আকাশে মেঘ-পাহাড়ের খেলা। বহুদূরে আঁকাবাঁকা তিস্তা, যা প্রায়শ হারিয়ে যাচ্ছে মেঘে। পাহাড়চূড়ায় যেন একটা গোল ছাদ। এখান থেকে দেখা যায় ৩৬০ ডিগ্রি। ডানপাশে একটা ছোট টিলা, এখান থেকে যাকে দেখতে শায়িত রবীন্দ্রনাথের মতো দেখাচ্ছে। হাতে মেঘ, জামায় মেঘ, টুপিতে মেঘ, নিশ্বাসে মেঘ। এ যেন মেঘেদেরই রাজধানী। গাভীর মতোই চরে বেড়াচ্ছে তারা।

অহলদারা আদতে একটি ভিউপয়েন্ট। থাকার জন্য দুটো হোমস্টে আছে। আমাদের গন্তব্য চা-বাগানের ঢাল দিয়ে নেমে নীতা চামলিংয়ের সানরাইজ় ভিউপয়েন্ট হোমস্টে। একেবারে রূপকথার গল্পে পড়া বাড়ি। ঘরের পিছনদিকে খাদ ও অনেক নীচে তিস্তা। ঘর থেকে বেরিয়ে একদিকে চা-বাগানের মধ্য দিয়ে সুঁড়িপথ, অন্যদিকে ভিউপয়েন্ট। পাশে ডাইনিং রুম। ব্যবস্থা বেসিক, কিন্তু পরিচ্ছন্ন। সবকিছু পুষিয়ে দেয় মিসেস চামলিং ও এখানকার লোকেদের ব্যবহার। বারান্দায় বসে অদ্ভুত লাগছিল। সামনে ঢেউখেলানো পাহাড়ের সারি। তা বেয়ে উঠে আসছে মেঘ। ঢেকে ফেলছে দিগন্ত। ধোঁয়া-ধোঁয়া সাদাটে লাগছে চারপাশ। কয়েক হাত দূরের গাছপালাও যেন অপার্থিব। নিজের সঙ্গে একান্ত হওয়ার দেশ এই অহলদারা। এখান থেকে হাত-ছোঁয়া দূরত্বে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। কিন্তু আমাদের কপাল মন্দ। আকাশের মুখ বেজার।

দ্বিপ্রাহরিক আহার সেরে বেরোলাম আশপাশ ঘুরতে। বৃষ্টিটা ধরেছে। চারদিকের অবিশ্বাস্য সৌন্দর্যের সঙ্গে ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করছি। অসাধারণ panoramic ক্যানভাস। যেন উপর থেকে নীচের পৃথিবীটাকে দেখছি। একদিকের পাহাড়গুলো পাইন, ফার গাছে সবুজ। নীচে বেঁটে-বেঁটে চা-গাছের সারি। শেষদুপুরে অলস পায়ে হেঁটে চললাম খানিক। বিকেলের নিভু আলোয় হোমস্টেতে ফিরে এলাম। ঠান্ডাটা বেশ কামড় বসাচ্ছে। মিসেস চামলিংয়ের স্পেশ্যাল মালাই চা নিয়ে বারান্দায় বসে শুরু হল জমাটি আড্ডা। ঝুপ করে সন্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার আর ঠান্ডা পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল। নিঝুম অহলদারা হয়ে উঠল প্রকৃতিরই অঙ্গ। আকাশ এখন প্রায় পরিষ্কার। চারদিকে নিঃসীম নৈঃশব্দ্য। আর-একটা করে জ্যাকেট চাপিয়ে তিন মক্কেলে বসে রইলাম হোমস্টের কাছেই একটা টিলার ওপর। মনে হচ্ছিল যেন একটা প্রকাণ্ড ন্যাড়া ছাদে বসে আছি। সন্ধ্যাপ্রদীপের মতো পাহাড়ের গায়ে একে-একে জ্বলে উঠল আলোকবিন্দু। চোখের সামনে ঝলমল করে উঠল একদিকে মংপু, অন্যদিকে চটকপুর। পিছনে তাকদা, তিনচুলে। পাহাড়জুড়ে আলোর উৎসব। আকাশপানে চেয়ে দেখলাম, আকাশভরা তারা যেন নেমে এসেছে ভুঁয়ে। তারাভরা আকাশেরই প্রতিলিপি পাহাড়ের গায়ে বসতি। একটু পরে এসে পড়ল গরম-গরম পকোড়া। মিসেস চামলিং-এর বদান্যতায় ক্যাম্পফায়ারের ব্যবস্থা হল। আগুন ঘিরে আমরা তিন মূর্তি। গা-সেঁকতে সেঁকতে চলল নির্ভেজাল আড্ডা, গিটারে লেনন-কোহেন-সুমন ও রেড ওয়াইন। রাতের দিকে ফের ঝমঝম বৃষ্টি। সংগতে মেঘের গর্জন। বারান্দায় মেঘ-আঁধার মিশে জমাট। সামনের ঝুপসি গাছটা পাগলের মতো মাথা ঝাঁকাচ্ছে। ম্রিয়মাণ আলোয় দেখলাম পরতে-পরতে মেঘ নেমে আসছে পাহাড় থেকে। তিস্তার বিস্তীর্ণ উপত্যকা কোথায় হারিয়ে একাকার।

পরদিন সকালেও আকাশ মেঘলা। ঘুমন্ত বুদ্ধ এ যাত্রায় আমাদের অদেখাই রয়ে গেল। বেলা বাড়তেই দেখি চড়া রোদ। আকাশের ব্যাকরণ এখানে খুব ঘন-ঘন বদলায়, যেন এই বহুরূপী স্বভাবই তার অলংকার। আজ আমরা যাব রবীন্দ্রস্মৃতি-বিজড়িত মংপু। যাওয়ার পথে দেখে নেব নামথিং পোখরি, লেপচা গুম্ফা, যোগীঘাট ব্রিজ ও অর্কিড গার্ডেন। জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। নামথিং পোখরিতে পৌঁছে দেখি একফোঁটাও জল নেই। শুনলাম নেপালের ভূমিকম্পের পর থেকে পোখরিতে এ সময় জল থাকে না। সারা দেশে একমাত্র এখানেই দেখা মেলে হিমালয়ান স্যালামান্ডারের। চারপাশ নিস্তব্ধ। একটা গা-ছমছমে ভাব। লেকের পাশে পাইনগাছেদের পাশে রেখে কাঁচারাস্তা। হেঁটে প্রায় লেকের ধার অবধি যাওয়া যায়। এরপর দেখলাম মাটি আর পাথরের তৈরি দু’শো বছরের পুরনো লেপচা গুম্ফা। ভেতরে নিংমা ধারার মূর্তি। ঘন্টাখানেক পর পৌঁছলাম যোগীঘাট। রিয়াং নদীর উপর শতাব্দীপ্রাচীন কাঠের ঝুলন্ত সেতু, পাশে নির্মিত হাল-আমলের ব্রিজ। নীচে খরস্রোতা নদীতে নেমে যাওয়া যায়। এর মধ্যেই রোদ-ঝলমল আকাশ বদলে গিয়ে শুরু হল মেঘেদের আনাগোনা। ফের বৃষ্টি, কিছুটা এগিয়ে তা প্রবল হল। উঁচু গাছের পাতার জল নীচের পাতায় পড়ে গড়িয়ে যেন সরগম তৈরি করছে। অর্কিড গার্ডেনের কেয়ারটেকার জানালেন, এ বছর গার্ডেনে অর্কিডের সংখ্যা কম। তবু যা দেখলাম, তাতেই মন ভরে গেল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছলাম মংপুর ‘রবীন্দ্রভবন’। মৈত্রেয়ী দেবী ও তাঁর স্বামী ডা. মনমোহন সেনের আতিথেয়তায় রবীন্দ্রনাথ চারবার এসেছিলেন এই বাড়িতে। কাচের দরজা-জানলাওলা দুধসাদা বাড়ি। প্রবেশপথের বাঁদিকে কবির মর্মরমূর্তি। সবুজ লন পেরিয়ে লম্বা টানা বারান্দা। বারান্দায় একটি আরামকেদারায় সাদা চাদরের উপর তাঁর ছবি। সামনে ফুলের অর্ঘ্য, সুগন্ধী ধূপ। এখানে কবি প্রতিদিন ভোরবেলা সমাহিত চিত্তে ধ্যানে বসতেন। এই বাড়িতে বসেই রবীন্দ্রনাথ লেখেন ‘জন্মদিন’-সহ বেশ কিছু কবিতা ও গান। ছবিও আঁকেন। তাঁর চেয়ার-টেবিলটি সযত্নে রাখা। ছবির সামনে পড়ে কিছু ক্যামেলিয়া। এ বাড়ির গাছটিকে নিয়েই কবি লিখেছিলেন ‘ক্যামেলিয়া’ কবিতাটি। সামনের বারান্দায় বসে লিখেছিলেন ‘মংপু পাহাড়ে’। তাঁর ব্যবহৃত জিনিস, পাণ্ডুলিপি সুন্দরভাবে সাজানো। সপ্তপর্ণী গাছটি আজও অক্ষত। বাড়িটি ঘুরিয়ে দেখান নেপালি কেয়ারটেকার শিশির রাউত, যাঁর ঠাকুরদা ছিলেন কবির এক পালকিবাহক। তিনি কথা বলতে বলতে কখনও চোখ বুজে কবিতা আওড়ান, কখনও গেয়ে ওঠেন, ‘জানি নে কোথায় জাগো ওগো বন্ধু পরবাসী….’

পরদিন ভোরে গেলাম পাঁচ কিলোমিটার দূরে লাটপাঞ্চর। এ অঞ্চলটি পক্ষীপ্রেমীদের স্বর্গরাজ্য। অজস্র ছোট বাঁশ, পাইন, অর্কিড, সিঙ্কোনার সমারোহ, বৃষ্টিভেজা মাকড়সার জাল, ঝুলন্ত মস, সবুজ অন্ধকার সরিয়ে পায়ে চলা। গহিন জঙ্গল আকাশ ছুঁতে চাইছে। যেন রণপা পরা সৈনিকের দল। শিশিরভেজা পাতার গায়ে প্রজাপতির মেলা। কত পাখির আনাগোনা, ভৈরবী আসর। প্রায় ৩৬ প্রজাতির পশু আছে এখানে। বার্কিং ডিয়ার, ব্ল্যাক বেয়ার, হনুমান, লেপার্ড আছে শুনলাম। মাঝে মাঝে হাতিও অনেকটা উঠে আসে। আর আছে রেড পান্ডা। এছাড়া প্রায় ২৪০ প্রজাতির পাখি আছে। সকালবেলা তাদের সমাবেশে জঙ্গলের নিস্তব্ধতা ভেঙে খানখান। নানা ধরনের হর্নবিল, মিনিভেট, বুলবুল, ম্যাগপাই, উডপেকার, ব্রডবিল এমনকী ঈগল বা পাহাড়ি শকুনও দেখা যায় এখানে। ফিরলাম প্রায় বিকেলে। রাতে ক্লান্তিতে বিছানায় লম্বমান হতে-না-হতেই ঘুমের রাজ্যে।

কাল সকালেই ফেরার পালা। আহা, প্রত্যেকদিন যদি ঘুম ভাঙত পাহাড়ঘেরা অহলদারার এই ছাদে! ফিরে আসব আবার, কোনও এক বসন্তে, এক জ্যোৎস্নারাতে!

Source: desh.co.in

Check Also

মাদার টেরিজার পর সিস্টার মরিয়ম, ভ্যাটিকানে ‘সন্ত’ উপাধি আরেক ভারতীয় সন্ন্যাসিনীকে

মাদার টেরিজার পর সিস্টার মরিয়ম, ভ্যাটিকানে ‘সন্ত’ উপাধি আরেক ভারতীয় সন্ন্যাসিনীকে | কেরলের সিরীয়-মালাবার চার্চের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *